প্রকাশিত,০১,আগস্ট, ২০২৪
সঞ্জিব দাস,গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
দেড় বছরের শিশু কন্যা ফারিস্তা। মাত্রই হাঁটতে শিখেছে। দুনিয়ার অনেক কিছু তার এখনো অজানা। তবুও তার চোখে যেন বাবাকে দেখার একধরনের ক্ষুধা।
বাবা, বাবা করে খুঁজে ফেরে তার প্রিয় বাবার মুখ। এখনো সে হয়তো বুঝতে পারেনি, তার বাবাকে সে কখনো দেখতে পাবে না। পাবে না বাবার আলিঙ্গন। ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা আন্দোলনে এলোপাতাড়ি গুলিতে শেষ হয়ে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। গুলিতে মারা যান টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ৩৪ বছরের যুবক মো: আতিকুল রহমান রুবেল।
গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বেলা ৩টায় অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলেন রুবেল। তখন জানতেন না যে, আর বাসায় ফেরা হবে না রুবেলের। কোটা আন্দোলনের সময় মিরপুর-১০ গোলচত্বর এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলি রুবেলের মাথায় এসে পড়ে। স্থানীয়রা প্রথমে আল-হেলাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
শেষ হয়ে গেল রুবেলের স্বপ্ন। পরদিন শনিবার রুবেলের লাশ গলাচিপায় নিয়ে আনা হয়। পরে গলাচিপা জৈনপুরী খানকায় প্রথম ও তার গ্রামের বাড়ি উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নের গ্রামমর্দ্দন এলাকায় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। জানা যায়, পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রূপনগর এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম মাস্টারের চার ছেলের মধ্যে সবার ছোট রুবেল। ২০০৭ সালে গলাচিপা সরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট থেকে গোল্ডেন এ+ নিয়ে এসএসসি শেষ করে বরিশাল সরকারি টেক্সটাইল কলেজ থেকে ২০১১ সালে টেক্সাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। পরে ঢাকা সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৪ সালে একই বিষয়ে বিএসসি সম্পন্ন করে ঢাকার বারিধারা এলাকায় জাস্টেক্স বায়িং হাউজে চাকরি হয় তার। সর্বশেষ সিনিয়র মার্চেন্ডাইজ পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালের ২৯ জুন পাশের রাঙ্গাবালী উপজেলার জসিম উদ্দিনের মেয়ে মোসা: তামান্না (২৬)-এর সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় রুবেলের। তাদের ঘরে আলিসবা ইসলাম ফারিস্তা নামের ১৭ মাস বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। খবর সংগ্রহ করতে ১৯ জুলাই রাতে যখন রুবেলের বাসায় যাওয়া হয়, হঠাৎ দৈনিক বাংলাদেশ বুলেটিন পত্রিকার প্রতিনিধি সঞ্জিব দাসকে দেখে রুবেলের বাবা বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলে রুবেলের নাম লিখতে আসছেন আপনারা’। তখনও রুবেলের বাবা জানতেন না যে তার ছেলে মারা গেছেন। গত মঙ্গলবার নিহত রুবেলের বাসায় গেলে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বাবা-মা। নিজেদের অজান্তেই ছেলের মুখ এখনো ভেসে ওঠে তাদের চোখে। ছেলের কথা মনে পড়লেই বুকফাটা চাপাকান্না এবং চোখের পানিতে কাতর হয়ে পড়েন বাবা-মা। বাসায় কেউ গেলে তাদের ধরে আহাজারি করে ওঠে রুবেলের বাবা-মা, স্ত্রীসহ পরিবারের সবাই।
বাবা শাহ আলম মাস্টার জানান, তখনকার সময় ৫০০ টাকা বেতনে রেজিস্ট্রি স্কুলে চাকরি করতাম। অল্প বেতনে ছয় সদস্যের সংসার চালানো খুবই কষ্ট ছিল। তখন গ্রামে থাকতাম। আমার ছেলে রুবেল মেধাবী হওয়ায় আমার বোন খাইরুন নাহার লিপি তাকে গলাচিপা এনে লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়। তার কাছেই থেকেই এসএসসি শেষ করে রুবেল। পাশাপাশি লিপির ভাই শামীম হাংও সহযোগিতা করেছে। আমার ছেলে খুবই ভালো ছিল। কোনো রাজনীতিও করত না। সমাজকর্মে জড়িত ছিল। পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে রুবেল ছিল বেশি স্বাবলম্বী। সব ভাইকে সহযোগিতা করত। আমাদেরকে এখন কে ডাক্তার দেখাবে ও খোঁজ নেবে। রুবেলের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ‘আমার বাবা ছিল আমার চাঁদ, আমার বাবা আমাদেরকে অন্ধকারের মধ্যে রাইখা গেছে।’ এ সময় তার ছেলে রুবেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে বাবা-মায়ের সাথে শেষ কথা হয় রুবেলের। এ সময় রুবেলকে সাবধানে থাকতে বলেন তারা।
রুবেলের স্ত্রী তামান্না জানান, ঘটনার দিন দুপুর ১২টায় রুবেল আমাকে ফোন দিয়ে গণ্ডগোলের মধ্যে বাইরে যেতে নিষেধ করে। সেটিই ছিল তার সাথে আমার শেষ কথা। বেলা ৩টা ৫২ মিনিটের সময় জানতে পারি রুবেলের গায়ে গুলি লেগেছে। তাৎক্ষণিক সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ছুটে যাই; কিন্তু ততক্ষণে আমার স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমার স্বামী তো কোনো দোষী না। তাহলে সে কেন মরল। এর দায় কে নেবে? তার ছোট একটা মেয়ে আছে। তাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে গেলাম।
নিহতের ফুপু মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খাইরুন নাহার লিপি জানান, রুবেলের লেখাপড়ায় বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করেছি। ঘটনা শুনে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ছুটে যাই; কিন্তু ততক্ষণে রুবেল আর বেঁচে নেই।
গলাচিপা উপজেলা পানপট্টি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: শামীমুর রহমান শামীম নিহত রুবেলের চাচা। তিনি জানান, উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি দুর্দশায়। রুবেলের এক ভাই প্রতিবন্ধী। পরিবারটির দিকে সরকারের সুনজর কামনা করছি। সরকারের সহযোগিতা পেলে পরিবারটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
আপনার মতামত লিখুন :