উপকূলে অবৈধ জালের দাপটে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য, মহাজনের ঋণে জিম্মি ৭৬ শতাংশ জেলে,


দেশ সময় প্রকাশের সময় : ২০২৫-১২-১০, ১১:২২ অপরাহ্ন /
উপকূলে অবৈধ জালের দাপটে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য, মহাজনের ঋণে জিম্মি ৭৬ শতাংশ জেলে,
print news || Dailydeshsomoy

প্রকাশিত

সঞ্জিব দাস, গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের তৈরি সংকট। উপকূলজুড়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অবৈধ জালের অবাধ ব্যবহারে ধ্বংস হচ্ছে নদী ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। অন্যদিকে জীবনমান উন্নয়নে হিমশিম খাওয়া জেলেরা আটকা পড়েছেন মহাজনের ঋণের জালে। কোস্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলের ৭৬ শতাংশ জেলেই মহাজন বা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পান মাত্র ১ শতাংশ জেলে। সম্প্রতি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় কোস্ট ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা-ডুবছে উপকূল-ডুবছে অধিকার’ শীর্ষক এক সেমিনার ও গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট ও কক্সবাজারের মোট ১২টি উপকূলীয় উপজেলায় এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গলাচিপা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সাইফুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. জহিরুন্নবী। গবেষণাপত্র ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম হেড মো. আবুল হাসান। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মহোৎসব

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বাড়তি আয়ের আশায় জেলেরা কারেন্ট জাল, মশারি, প্লাস্টিক জাল, বিন্দি, ঠেলা ও খুঁটা জালের মতো নিষিদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নদীর মোহনা ও ডুবোচরে বাঁশ বা গাব গাছের খুঁটি দিয়ে এসব জাল পেতে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এতে মা মাছসহ জলজ প্রাণীর বংশবিস্তার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ঋণের জালে বন্দি জীবন জেলেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার করুণ চিত্র , মাত্র ২২ শতাংশ জেলের নিজস্ব নৌকা বা ট্রলার রয়েছে। বাকি ৬৭ শতাংশ অন্যের নৌকায় এবং ১১ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অভাবে ৭৬ শতাংশ জেলে মহাজনের কাছ থেকে এবং ২৩ শতাংশ এনজিও থেকে ঋণ নেন। ব্যাংক ঋণ পান মাত্র ১ শতাংশ। জেলে পরিবারের ঋণের গড় পরিমাণও উদ্বেগজনক। প্রায় ৩৭ শতাংশ পরিবারের ঋণের বোঝা ১ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত।

গবেষণায় দেখা যায়, জীবনঝুঁকি নিয়ে সাগরে গেলেও জেলেদের নিরাপত্তায় নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। উদাহরণ হিসেবে গলাচিপা উপজেলার চিত্র তুলে ধরা হয়। এখানে ২১৫০টি ট্রলারের মধ্যে বড় ও মাঝারি ট্রলার রয়েছে ১৩৭৮টি। সরকারিভাবে নিবন্ধিত থাকার কথা থাকলেও ৯০ শতাংশ ট্রলারেরই কোনো নিবন্ধন নেই। বড় ট্রলারগুলোতে জিপিএস থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৬ শতাংশের। জীবন রক্ষাকারী লাইফ জ্যাকেট বা বয়ার তীব্র সংকট রয়েছে। দরিদ্রতার কারণে জেলেদের সন্তানদের ১৯ শতাংশই স্কুলে যায় না। এছাড়া মেয়েদের বাল্যবিয়ের হার আশঙ্কাজনক। ৩৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১২-১৪ বছর বয়সে এবং ৩৭ শতাংশের বিয়ে হয় ১৫-১৬ বছরের মধ্যে।
সংকট নিরসনে সেমিনারে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ১. অবরোধকালীন সময়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে জেলে পরিবারপ্রতি মাসিক ভাতা ন্যূনতম ৮০০০ টাকা করা। ২. নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া। ৩. সমুদ্রগামী সকল নৌযানে জীবন সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করা। ৪. জেলেদের জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা। সেমিনারে বক্তারা বলেন, টেকসই উদ্যোগের অভাবে উপকূলের জেলেরা খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নদী ও জেলেদের বাঁচাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।