প্রকাশিত,১৮, নভেম্বর,২০২৩
ডেক্স রিপোর্টঃ
সারাদেশে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র আঘাতে বৃষ্টি-ঝড়ো হাওয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ শুক্রবার দেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে। এতে বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে এর প্রভাবে বরিশাল, বরগুনা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দিনভর বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে এসব এলাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। গাছপালা ভেঙে পড়ে। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে কয়েকটি স্থানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কক্সবাজারের টেকনাফে দেওয়ালচাপায় একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে ঘরের ওপর গাছ পড়ে মারা গেছেন এক নারী। ভোলায় তিন শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
এদিকে ঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়। নদীপথে সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। বরগুনা ও ভোলার মনপুরায় উত্তাল সাগরে দুটি ট্রলার এবং মোংলায় কয়লাবোঝাই একটি লাইটার জাহাজ ডুবে গেছে। খোঁজ মিলছে না ২০টি ট্রলারসহ কয়েকশ জেলের। টানা বর্ষণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বোরো ও আমনের। এতে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।
শুক্রবার বিকাল ৪টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপিতে বলা হয়েছে-ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করেছে। উপকূলে আঘাত হেনে এটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মোংলা ও পায়রা বন্দরে দেওয়া ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরেও ৬ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল পটুয়াখালীতে। বেলা ৩টায় সেখানে ঘণ্টায় ১০২ কিলোমিটার গতিতে বাতাস বয়ে যায়।
টেকনাফে দেওয়ালচাপায় এক পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু কক্সবাজারের টেকনাফে বাড়ির দেওয়ালচাপায় একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড মরিচ্যাঘোনা পানিরছড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মৃতরা হলেন-ওই এলাকার মোহাম্মদ ফকিরের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০), মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)। তবে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন মোহাম্মদ ফকির। হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী জানান, নিুচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার সারা দিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। রাত আড়াইটার দিকে মোহাম্মদ ফকিরের মাটির তৈরি ঘরের দেওয়াল চাপা পড়ে তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে মারা গেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটিকে এক লাখ টাকা সহযোগিতা করা হয়েছে। এদিকে নিজে বেঁচে গেলেও স্ত্রী-ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মোহাম্মদ ফকির। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা, বন্দরে পণ্য ওঠানামা বন্ধ : বৃষ্টিতে নগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, বাকলিয়া, চকবাজারের ফুলতলাসহ আশপাশের বিভিন্ন নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ছুটির দিন হলেও জরুরি প্রয়োজনে যারা ঘরের বাইরে বের হয়েছে, তাদেরকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। যানবাহন সংকটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অনেককে। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে শুক্রবার সকাল থেকে জাহাজে পণ্য ওঠানামা বন্ধ করে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। জেটিতে অবস্থানরত ২২টি জাহাজ পাঠিয়ে দেওয়া হয় বহির্নোঙরে। ফলে বন্দরের জেটিগুলো হয়ে পড়ে জাহাজশূন্য। জারি করা হয়েছে নিজস্ব দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট-৩’।
বরিশালে জলাবদ্ধতা : বৃহস্পতিবার রাত থেকে নগরীতে একটানা বৃষ্টি হয়। এতে নিুাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। নগরীর অধিকাংশ সড়কে হাঁটুপানি জমে যাওয়ায় চলাচলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন বাসিন্দারা। লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় বিভিন্ন রুটের যাত্রীদের নদী বন্দরে এসে ফিরে যেতে দেখা গেছে। নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ বরিশালের সহকারী পরিচালক রিয়াদ হোসেন বলেন, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে অভ্যন্তরীণ ও ঢাকা-বরিশাল রুটের সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে।
মোংলায় কয়লাবোঝাই জাহাজডুবি : মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের দক্ষিণ চরে শুক্রবার দুপুরে কয়লাবোঝাই লাইটার জাহাজ এমভি প্রিন্স অব ঘষিয়াখালী-১ ডুবে গেছে। এ সময় সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন লাইটারের ১১ কর্মচারী। লাইটারটি যশোরের নোয়াপাড়া ঘাটে যাচ্ছিল। ঝড়ে ডুবোচরে আটকে এর তলা ফেটে যায়। এতে ৮০০ টন কয়লা ছিল।
রেললাইনে গাছ পড়ে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম-সিলেটের ট্রেন বন্ধ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কালীসীমায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় রেললাইনের ওপর গাছ ভেঙে পড়েছে। এতে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম- নোয়াখালী ও সিলেটের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চলাচল বন্ধ ছিল।
গোসাইরহাট (শরীয়তপুর) : উপজেলার নাগেরপাড়া বালিকুড়ি গ্রামে বিকালে ঘরের ওপর গাছ পড়ে নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম জুলেখা বেগম (৬৫)। নাগেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক খান এ তথ্য জানিয়েছেন।
ভোলা ও লালমোহন : জেলায় তিন শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। জেলা সদরের বিদ্যুৎ লাইনের ওপর ৩৬টি গাছ পড়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দুপুর ১২টা থেকে জেলার সর্বস্ত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। মনপুরায় একটি ট্রলার ডুবে নিখোঁজ তিনজনকে ৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়েছে। অপরদিকে তজুমদ্দিনের মেঘনায় ২টি ট্রলার ডুবে গেছে। এতে এক জেলে নিখোঁজ রয়েছে। এ ছাড়া ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে ফেরির তলা ফেটে পানি প্রবেশ করে।
পাথরঘাটা ও আমতলী (বরগুনা) : বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পাথরঘাটা উপজেলার ছালাম মিয়ার মালিকানাধীন এফবি নিশাত নামে একটি মাছ ধরার ট্রলার ১৮ জেলেসহ দমকা বাতাসে উলটে যায়। এ সময় অন্য একটি ট্রলারের জেলেরা তাদের উদ্ধার করে। এছাড়াও পাথরঘাটা উপজেলার ২০/২৫টি মাছ ধরার ট্রলারসহ অন্তত ৩শ জেলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম বলেন, ট্রলার ও জেলেদের খোঁজার জন্য কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো হয়েছে। এদিকে আমতলী উপজেলা কৃষিবিদ ঈশা বলেন, ঝড়ো বাতাসের কারণে অনেক স্থানে আমন ধানের গাছ হেলে পড়েছে। সবজি খেতে পানি জমেছে।
বাগেরহাট : বাগেরহাট সদর উপজেলা, কচুয়া, ফকিরহাট, চিতলমারী, মোল্লাহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার হেক্টর ধানের বীজতলা ডুবে গেছে। এছাড়া পেঁপে, কলাসহ বিভিন্ন সবজি খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পিরোজপুর, ভাণ্ডারিয়া ও ইন্দুরকানী : জেলার বিভিন্ন স্থানে আমন ধানের খেতে পানি জমেছে। হেলে পড়েছে ধানের গাছ। এছাড়া পানের বরজ, কলা ও পেঁপে গাছ নুইয়ে পড়েছে। ইন্দুরকানীতে গাছপালা ভেঙে রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বান্দরবান : বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির শঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ছেড়ে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় রুমা, থানচি, লামা-সূয়ালক, থানচি-আলীকদমসহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো কাদামাটিতে পিচ্ছিল হয়ে বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে।
চাঁদপুর : বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুর বন্দর ও পরিবহণ কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন জানান, সকালে ছোট লঞ্চগুলো বন্ধ করা হলেও বেলা ১১টার দিকে ঢাকা-চাঁদপুর, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ চাঁদপুর থেকে সব রুটের লঞ্চ ও নৌযান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
মুলাদী (বরিশাল) : চরকালেখান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম সরদার জানান, ঝড়ে কয়েকশ গাছপালা ভেঙে পড়েছে। ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় আমন ধান, সরিষা, খেসারি ও মসুর ডাল নষ্ট হয়েছে। মুলাদী পল্লী বিদ্যুতের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. হুমায়ুন কবীর জানান, ঝড়ে ৭-৮টি খুঁটি ভেঙে যাওয়ার খবর পেয়েছি।
নোয়াখালী ও হাতিয়া : শুক্রবার সকাল থেকে প্রশাসনের নির্দেশে হাতিয়া থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরে থাকা মাছ ধরার ট্রলারগুলো তীরে ফিরে এসেছে।
এছাড়া বরগুনার তালতলী, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, খুলনার কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, মীরসরাইয়ে আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।