প্রকাশিত, ০৬ অক্টোবর, ২০২৩
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি ঃ
ময়মনসিংহে ভয়াবহ বৃষ্টিপাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ও জেলার প্রায় সকল উপজেলায় জনদুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে। এক রাতের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নগরীর বেশিরভাগ রাস্তাঘাট। পানি উঠেছে বাসা বাড়ি দোকানে। বাসায় পানি উঠায় অনেকের নির্ঘুম রাত কেটেছে।
নগরীর ব্রাক্ষপল্লী এলাকায় বাসায় হাটু পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠে মারা গেছেন পলি (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ। তিনি ওই এলাকার মৃত জিতু মিয়ার ছেলে। উপজেলাগুলোতে তলিয়ে গেছে ধান ক্ষেত। বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে পুকুর-ফিসারির মাছ। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত টানা ভারি বর্ষণ হয়। এর আগে সারাদিন জেলার সব উপজেলাতে বৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মযমনসিংহ নগরীর গাঙ্গিনারপাড়, ধোপাখলা, চরপাড়া, নতুন বাজার, স্টেশন রোড, নয়াপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী, কালিবাড়ি, গুলকিবাড়ি, আমলাপাড়া, ভাটিকাশর, কালিবাড়িসহ নগরীর অনেক এলাকা হাটু পানি ও কোমর সমান পানি জমেছে। এসব এলাকার বাসা বাড়ি দোকানে পানি ওঠেছে। অনেক পরিবার নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। নগরীর বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে।
নগরীর বাউন্ডারি রোড এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, ভয়াভয় বৃষ্টিপাতে বাসার নিচে ও সামনের রাস্তায় পানি উঠে গেছে অনেক দূর্ভোগে আছি।
নগরীর ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় আটকে পড়া ইমরুল হাসান ইমন বলেন, ভাবি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার জন্য বাসা থেকে খাবার আনতে শিকারিকান্দা এলাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাটু সমান পানিতে আটকা পড়েছি। বৃষ্টিতে সড়কে গাড়িও চলছে না।
নগরীর গোলাপজান রোড এলাকায় একটি ছাত্রাবাসে থাকেন আনন্দমোহন কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান। সেখানে পানি উঠে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন। এমন অবস্থা পুরো নগরী জুড়েই।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক জাকিউল ইসলাম বলেন, হাসপাতাল চত্ত্বরের কিছু এলাকা নিচু হওয়ায় পানি ঢুকে পড়েছে। স্টাফ কোয়াটারগুলোর নিচতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। গত রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর দিয়ে চিকিৎসা সেবা চালু রাখা ছিল। তবে, সকাল থেকে বিকল্প বিদ্যুৎ লাইনে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা চালু রয়েছে।
রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের পরিদর্শক শাহীনুর ইসলাম বলেন, রেলপথ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিগন্যাল পয়েন্ট কাজ করছে না। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বিঘ্ন হচ্ছে।
এদিকে, গত রাত ১০ টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালী এলাকার পাওয়ারগ্রীডের কন্ট্রোল রুমে পানি উঠে যায়। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তিন ঘণ্টা কন্ট্রোল রুমের পানি সেঁচে বের করেন। এ ঘটনায় বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাত দুইটার পর আবার কন্ট্রোল রুমে পানি জমে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রীড বন্ধ রয়েছে। এতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে নগরীর বেশ কিছু এলাকা।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ ফায়ার স্টেশন অফিসার জুলহাস উদ্দিন বলেন, রাত ১০ টার দিকে কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রীড থেকে খবর আসে কন্ট্রোল রুমে পানি ডুকেছে। এমন খবর পেয়ে পাওয়ারগ্রীডে ৩ ঘণ্টা সেঁচে পানি পরিস্কার করি। পরে রাতে আবারও কন্ট্রোল রুমে পানি ডুকেছে শুনেছি।
ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (দক্ষিণ) নির্বাহী প্রকৌশলী ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে কেওয়াটখালী পাওয়ারগ্রীের কন্ট্রোল রুমে পানি ডুকে বন্ধ রয়েছে। এতে নগরীর স্টেশন রোড, পাদ্রী মিশন, চরপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ঠিক হতে কত সময় লাগবে তা এখন বলা যাচ্ছে না।
সিটি কর্পোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া এলাকায় অন্তত ৫০০ একর ধান ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, আমি ৮ কাটা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। গত রাতের বৃষ্টির পানিতে সব ধান ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
একই এলাকার নেকবর মিয়া বলেন, আমি চার কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার সব পানিতে তলিয়ে গেছে।
মদর উপজেলার চর হরিপুর এলাকার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ১০ শতাংশের পুকুর ডুবে সব মাছ ভেসে গেছে। এতে ৫০ হাজার টাকার মাছ ভেসে গেছে।
একই এলাকার শামীম আহমেদ বলেন, আমার প্রায় ৩০ কাটা ধানি জমি তলিয়ে গেছে।
একই এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, বাড়ির চারপাশে অপরিকল্পিত পুকুর ও ফিসারি। এই কারণে বাড়ি ঘরে পানি উঠে গেছে। গরু ছাগল নিয়ে বিপাকে আছি। রান্না ঘরে পানি উঠায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
লিপি আক্তার বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতেই বাড়ি ঘর তলিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে খুব বিপদে আছি। চারপাশে অপরিকল্পিত ফিসারির কারণে আজ আমাদের এই দুর্দশা।
চর হরিপুর এলাকার জয়নাল বলেন, ১৭ কাঠা জমি লিজে নিয়ে ফিসারি দিয়েছি। এক রাতের বৃস্টিতে সব ফিসারি তলিয়ে গেছে। মাছ যেন ফিসারি থেকে না যেতে পারে তাই নেট জাল বাধ দিচ্ছি। আমার অন্তত ১৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
চর হরিপুর মজিবুর রহমান বলেন, এমন বৃষ্টি দেখছি বহুবার কিন্তু এভাবে পানি জমতে দেখিনি কখনো। আমার ১০ কাঠা ধান জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে কিছুটা দুরে ১২ কাঠা জমিতে ফিসারি ছিল। সব ফিসারি তলিয়ে গেছে। আমার অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে।
একই এলাকার মরম আলী বলেন, আমার ১৭ কাঠা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ১৫ কাঠা ফিসারির মাছ ভেসে গেছে। চর হরিপুর, বাজিতপুর ও আলালপুর গ্রামে অন্তত হাজার একর ফিসারি তলিয়ে গেছে।
জেলার গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কাঠবাড়ি এলাকার এরশাদুল বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতে আমার এক কাঠা মেহগনি গাছের বাগান ভেঙ্গে চলে গেছে। একটা ফিসারিতে দুই লাখ টাকা মাছ ছিল। তাও ভেসে গেছে।
গফরগাঁও পৌর শহরের শিবগঞ্জ রোডের ১ ও ২ নম্বর গলির ভিআইপি গলিসহ বেশির ভাগ বাসা বাড়িতে পানি ডুকেছে। এছাড়া পৌর শহরের প্রতি ওয়ার্ডে কম বেশি রাস্তার উপরে পানি উঠেছে। তাছাড়া, উপজেলার অনেক এলাকার ফিসারির মাছ ভেসে গেছে পানিতে। ধানি জমিতেও পানি জমেছে।
ওই উপজেলার চরআলগী ইউনিয়নের চর কামারিয়া নদীর পাড়ে এক মাস আগে ছোট ব্রীজ তৈরী করা হয়েছিল। যা গত রাতের বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। এতে স্থানীয়দের চলাচলের বিগ্ন ঘটছে।
এছাড়াও জেলার ভালুকায়, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইলসহ প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বৃষ্টিতে জনদূর্ভোগ দেখা দিয়েছে।
এ বিসয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মতিউজ্জামান বলেন, জেলার সব উপজেলায় ধান ক্ষেত তলিয়ে গেছে। তবে, কি পরিমাণ ধান ক্ষেত তলিয়েছে তার কোন হিসাব এখনো করা হয়নি। পানি নেমে গেলে হিসাব করা যাবে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলেন, বৃষ্টি কিছুটা কমায় পানিও কমতে শুরু করেছে। দ্রুত পানি সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে একটি টিম কাজ করছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত রাতের বৃষ্টিতে সবচাইকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ মাছ চাষের। ১৩ উপজেলায় প্রচুর ফিসারি তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া প্রতি উপজেলায় অনেক ধান ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির এখনো সঠিক পাওয়া যায়নি। তবে, হিসাব সংগ্রহ করছি। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।