নির্বাচনের বছর। করোনা মহামারির ধকল এখনো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যুদ্ধের প্রভাব সর্বত্রই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই। এমন সময়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের তাগিদ এসেছে এবং এ ঋণ শোধ করতে হবে আগামী চার মাসের মধ্যেই।
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ১২ বিলিয়ন ঋণ শোধ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসা এবং ডলার সংকটের কারণে এই পরিমাণ ঋণ এখন শোধ করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ বলছে এ ঋণ পরিশোধ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনজীবনে’-এমন প্রশ্ন নিয়ে মতামত গ্রহণ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশের।
চার মাসের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা বাংলাদেশ সরকারের জন্য খুবই কঠিন হবে- এমনটি উল্লেখ করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আসলে ঋণ নেওয়ার বেলায় আমরা সঠিকভাবে ভাবি না। যে কারণে ঋণ নিই, সেখানেও দুর্বলতা থাকে। প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ হয় না।
‘বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল বলে মনে করি। ১২ বিলিয়ন ডলার সরকার একবারে কীভাবে দেবে? আমার কাছে মনে হয় ধাপে ধাপে দেওয়ার ব্যাপার। চার মাসের মধ্যে পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে। আগেও ঋণ শোধ করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে সময় বেঁধে দিয়ে এত বিশাল অঙ্কের টাকা পরিশোধ করা সরকারের জন্য কঠিন হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ আছে ৩০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হলে রিজার্ভ আরও ঝুঁকিতে পড়বে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আপাতত কোনো ভালো খবর নেই উল্লেখ করে বলেন, ‘রেমিট্যান্স খুব নিয়মিত অবস্থানে নেই। অস্থিরতা বিরাজ করছে। একবার বাড়লে আবার কমছে। রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব হয়নি। আমরা একমুখী রপ্তানি আয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। সস্তা শ্রমে ভর করে পোশাকখাতেই আমরা আটকে আছি। আরও পণ্য রপ্তানি করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজারে। চামড়াশিল্প আমরা ধ্বংস করে ফেলছি। চা-পাট শিল্প নিয়েও সরকারের মধ্যে তাগিদ নেই। দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাও বাড়ছে। আইএমএফের লোনটাও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। এটি ঠিকমতো সরবরাহ হলে সংকট কিছুটা কমতো।
প্রায় একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন অধ্যাপক এম এম আকাশও। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের চলতি হিসাব বাড়ানোর জন্য মূলত তিনটি বিষয় বিবেচ্য। রপ্তানি আয় বাড়ানো, আমদানি কমানো এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধি। আমাদের এখন দেখতে হবে এই তিনটি সেক্টর কী অবস্থায় আছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, খুব ভালো অবস্থায় নেই। অন্তত মূল্যস্ফীতি, বাজার পরিস্থিতি এবং রিজার্ভের অবস্থা তাই প্রমাণ করে। রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ৫০ বিলিয়ন থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসা ভালো লক্ষণ নয়। আমরা পাশের দেশ শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখতে পেলাম।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘চলতি হিসাব থেকে যদি ১২ বিলিয়ন ডলার আমরা শোধ করতে না পারি তাহলে রিজার্ভ থেকে দিতে হবে। চার মাসের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা মানে বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে। যদি না আমরা রিজার্ভের পরিমাণ বাড়াতে পারি।’
‘১২ বিলিয়ন ডলার শোধ করলেই তো শেষ নয়। বহু ঋণ করেছে সরকার। এ চাপ সবার ওপরে পড়বে। বিপদ বাড়বে। রপ্তানি আয়, আমদানি কমানো আর রেমিট্যান্স বাড়ানোর ক্ষেত্রে নজর বাড়ানো দরকার। আবার আমদানি কমিয়ে আপনি উৎপাদন বাড়াতেও পারবেন না। রিজার্ভ কমা মানে ঝুঁকি বাড়া। যে কোনো সময় রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ে রিজার্ভের কারণে। বৈদেশিক ঋণ শোধ মানেই রিজার্ভে চাপ বাড়ানো।’
এএসএস/এএসএ/জেআইএম
আপনার মতামত লিখুন :