প্রকাশিত,১৪,ডিসেম্বর,২০২৩
গাজী আহমেদ উল্লাহ।
‘নীলনকশার রেখা অংকন শুরু হয়েছিল একাত্তরের পয়লা মার্চের আগেই সত্তরের ১৭ ডিসেম্বর গণভোট বা তারও আগে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় থেকেই, কিংবা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে। একাত্তরে তারা প্ল্যান করে যুদ্ধে নামে। যুদ্ধ তো নয়, কেবল নিরস্ত্র মানুষ নিধন।
প্রথমে ওদের এলোপাতাড়ি মারা, তারপর শহরে গ্রামে গঞ্জে বেছে বেছে ধনী, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবীকে নিধন করে নদীতে খালে ফেলে দেওয়া। অনেকে মনে করেন চরম বিপর্যয় আসন্ন, পরাজয় একেবারেই সন্নিকটে- তখনই তারা সেই পরিকল্পনা কার্যকর করে। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এভাবেই অন্ধকার করার পাঁয়তারা করেছিল।’
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহিদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সহধর্মিণী বাসন্তী গুহঠাকুরতা তার একটি গ্রন্থে এমনটিই লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা অনেক আগেই হয়েছিল। অনেকটা প্ল্যান বি’র মতো করে বিজয় দিবসের এক দিন আগেই চূড়ান্তভাবে যেটি বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসররা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর এবং সামরিক জান্তা পরিকল্পনা করেছিল, দেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করতে পারলে বাংলাদেশ কোনোদিন স্বাধীন হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এই চিন্তা থেকেই তারা বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীরে হত্যা করতে শুরু করেছিল। যদিও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকেই আসলে সারা দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার আর হত্যা শুরু হয়েছিল। কিন্তু নভেম্বর মাস থেকে সেই কর্মকাণ্ড আরও জোরদার করে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা। মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। তারা তাদের এদেশীয় দোসরদের নিয়ে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষ হত্যা করে। এসব বুদ্ধিজীবী তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নিজেদের পেশা ও লেখনীর মাধ্যমে আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলেছিলেন এসব বুদ্ধিজীবী।
২৫ মার্চের কালরাত থেকেই ঘাতক-দালালদের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ফজলুর রহমান খান, গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ আরও অনেকেই এই কালরাতেই শহিদ হন। শুধু ঢাকা কেন, বাংলাদেশজুড়েই (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলছিল এই হত্যা প্রক্রিয়া। সিলেটে চিকিৎসারত অবস্থায় হত্যা করা হয় ডাক্তার শামসুদ্দিন আহমদকে।
শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ছাত্র কেউই এই ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাননি। প্রতিদিন কারও না কারও বাসায় ঢুকে বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো অজ্ঞাত স্থানে। যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো, নারকীয় নির্যাতনের পরে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হতো। ওরা কেউ আর ঘরে ফিরে আসেনি। দু-একটি ব্যতিক্রম হয়তোবা ছিল। কিন্তু সেইসব ভাগ্যবানের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো ছিল না। অর্থাৎ পাকিস্তানি ঘাতকরে আত্মসমর্পণের ঠিক একদিন আগে ১৪ ডিসেম্বরের বীভৎস নারকীয় পাশবিক হত্যাকাণ্ড ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। একসঙ্গে এত বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি। ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্য বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। ঘাতক-দালাল চক্র এই পৈশাচিক-নির্মম নিধনযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আত্মীয়-স্বজনরা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের মরদেহ খুঁজে পান। ঘাতক বাহিনী আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল।
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, ‘আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতে যে মাটির ঢিবিটি ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। গামছা দুটি আজও ওখানে পড়ে আছে। পরনে কালো ঢাকাই শাড়ি ছিল। এক পায়ে মোজা ছিল। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে- যেন চেনা না যায়। মেয়েটি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবতী। স্তনের একটা অংশ কাটা। মরহেটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বীভৎস চেহারার দৃশ্য বেশিক্ষণ খো যায় না। তাকে আমি চিনতে পারিনি। পরে অবশ্য শনাক্ত হয়েছে যে, মেয়েটি সেলিনা পারভীন। ‘শিলালিপি’র এডিটর। তার আত্মীয়রা বিকালে খবর পেয়ে লাশটি তুলে নিয়ে গেছে।’
আরেকটি বর্ণনা, ‘পাশে দুটো লাশ, তার একটির হৃৎপিণ্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া মানুষটিই হলো ডা. রাব্বী।’ ডা. রাব্বীর মরহেটা তখনও তাজা। জল্লাদ বাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত যে, তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তার হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছে।’ এমনি আরও অজস্র লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। সেসব মর্মান্তিক ঘটনা শুনে বারবার শিউরে উঠতে হয়।
লেখনী ছিল বুদ্ধিজীবীদের মূল অস্ত্র, যা তাদেরকে পাকিস্তানি ও রাজাকার-আলবদরদের কাছে শত্রুতে পরিণত করে। জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে অবদান রাখেন এসব বুদ্ধিজীবী। তাদের সুচিন্তিত দিকনির্দেশনায় অনুপ্রাণিত হতেন বাংলাদেশের স্বাধিকারের জন্য লড়াকু রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা এবং সচেতন দেশপ্রেমীরা। তাই তাদের নিধনের মধ্য দিয়ে জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র পেরিয়ে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন না হলেও বাঙালি জাতিকে মিয়ে রাখার, পরাধীন করার ষড়যন্ত্র এখনও চলমান। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ আরও সমৃদ্ধ হবে, আরও দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে।