গ্রামীণ শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।
ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের যে ২০২৪ এর নতুন স্বাধীনতা এসেছে তা শুধু অপশক্তি হতে দেশকে বাঁচিয়ে আবার আগের নিয়মের চলার জন্য নয়। এবারের স্বাধীনতা সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জন্য এবং পুরানো বৈষম্য, অবহেলার নীতিকে ভেঙে নতুনকে গড়ার জন্য।
বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশে যে সব সেক্টরকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার মাঝে সবচেয়ে করুণ দশা হয়েছে শিক্ষা খাতের। ৫২ সালে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে, ৭১ এ স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা একটি সর্বস্তরের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা পেলাম না। ২০২৪ এর স্বাধীনতার কাছে এটাই আমার প্রত্যাশা থাকবে এবং সেজন্যই এই লেখার সূচনা।
এদেশে শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বড় বৈষম্য হচ্ছে সারাদেশে অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক এবং অবিবেচনাপ্রসূত কারিকুলাম। আপনারা যারা ঢাকায় বসে কারিকুলাম আর পাঠ্যপুস্তক প্রনয়ণ করেন, তারা একবারও ভাবেন না আমার গ্রামের প্রত্যন্ত চরের ছেলেটাকে এগুলো শেখাবে কে?
শহরের শিক্ষিত বাবা মা যে বই পড়ানোর জন্য নামী-দামী বিদ্যালয় খোঁজেন, ১০-২০ হাজার টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র রেখে সন্তানকে পড়ান, এক কোচিং সেন্টার থেকে আরেক স্যারের কাছে ছুটোছুটি করে সকাল-বিকাল; সেখানে গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কৃষক পিতা-মাতার সন্তানকে এসব বইয়ের পড়া কে শেখাবে? তাদের তো কয়েকশো টাকা দিতেও হিমশিম খেতে হয়।
এখানে কোন ভালো কোচিং সেন্টার শাখা খুলতে আসে না; আর কোন ভালো ছাত্রটাই বা প্রাইভেট পড়ানোর জন্য গ্রামে পড়ে থাকবে? তাহলে যেখানে এই বইগুলো ভালোমতো আত্মস্থ করার পরিবেশই নেই সেখানে এগুলো চাপিয়ে দেওয়া অনেক বড় বৈষম্যের কাতারেই পড়ে।
এরকম গ্রাম বাংলাদেশে একটি কিংবা দুটি নয়, হাজারে হাজারে আছে আর তার ভুক্তভোগী বহুলক্ষ দরিদ্র, মেধাবী শিক্ষার্থী। আর এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা এটাই নিশ্চিত হচ্ছে যে শহরের ছেলেরা উন্নত পরিবেশে পড়াশোনা করে অফিসার হবে, আর গ্রামের ছেলেদের হতে হবে তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী অথবা শ্রমিক। এই বৈষম্য অবশ্যই দূর হতে হবে।
বিগত বাকশাল আমলে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গ্রামের শিক্ষার্থীদের বলীর পাঠা বানানো হয়েছে। অটো পাস, প্রশ্ন ফাঁস, নকল ইত্যাদির মাধ্যমে পাসের হার ৯০% এ উন্নীত দেখানো হয়েছে, অথচ এর মাধ্যমে শিক্ষাদানের পরিবেশ গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আমরা ময়মনসিংহস্থ গফরগাঁও উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জেনেছি অনেকেই এসব পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষাদানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। নবম-দশম ছেলে মেয়েরাও একটি ইংরেজি বাক্য পড়তে কিংবা একটি সাধারণ বীজগণিত করতে হিমশিম খায়। অথচ এই সময় আমরা দেখেছি যে শিক্ষা খাতে প্রচুর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা নীতি ও ব্যাবস্থাপনার ব্যর্থতার দরুন সেগুলো কোন কাজে লাগেনি। মূলত এই একটি বৈষম্য দূর করতে না পারলে এসব অনুদান ভবিষ্যতেও কোন কাজে লাগবে না।
আমরা গ্রামের মানুষেরা কখনোই চাইবো না, আমাদের সন্তানদের জন্য শহরের বাচ্চাদের উন্নত শিক্ষা আহরন যেন বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের চাওয়া আমাদের গ্রামের ছেলেটাও যেন গ্রামের অনুন্নত পরিবেশে থেকে যথাযথ শিক্ষা পায় এবং নিজের ভবিষ্যত গড়তে পারে। আর এজন্যই পৃথক গ্রামীণ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং তার আলোকে পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য অবকাঠামোর পরিবর্তন আনতে হবে। প্রিয় নেতা জনাব তারেক রহমান প্রণীত ৩১ দফায় শিক্ষার মাধ্যমে যে যোগ্য, দক্ষ ও মানবিক জনগোষ্ঠী গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন তা শুধু পৃথক শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমেই সম্ভব।
যতো শিল্পই গড়ে উঠুক না কেন কৃষির চাহিদা থাকবেই। এটি এমন একটি অনুষদ যেখানে বিজ্ঞান, বানিজ্য, অর্থনীতি, সমাজ কল্যাণ সব কিছুই আছে। একটা গ্রামের ছেলে অথবা মেয়ে হাঁটতে শেখার পর থেকেই বাড়ির কৃষিকাজের সাথে যুক্ত হয়। যেমন যেখানে ধানের চাষ হয় সেখানে বছরে দুটি ধানের মৌসুমে দুই-তিন সপ্তাহ শুধু ধান নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। বন্যার সময়।
জান-মাল বাঁচাতে ব্যস্ত থাকতে হয়, প্রত্যহ হাটে দুধ বেচতে যেতে হয়। এ সময়গুলো কোন পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু তাদের কৃষি কাজটুকুই ব্যবহারিক শিক্ষা হিসেবে গণ্য করা যায়। কৃষি বিজ্ঞানের সকল শাখাই সংক্ষিপ্ত আকারে গ্রামীণ শিক্ষা নীতির আওতাভুক্ত বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। জ্ঞানী গুণী শিক্ষাবিদেরা যতোই দেশ বিদেশের জ্ঞান দিতে চান, গ্রামের বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম হবে তাদের পরিবেশ হতে জ্ঞান দান করা।
শক্তপোক্ত গ্রামের ছেলে মেয়েদের ছোট হতেই যথাযথ শারীরিক এবং নৈতিকতা শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং ক্রীড়া জগতের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা যায়। অগ্নি নিরাপত্তা, উদ্ধারকর্মী ইত্যাদি বিষয়ে ছোট বেলা থেকেই দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে ভালো পদে নিযুক্ত হতে পারে।
যেহেতু গ্রামের ছেলেদের প্রবাসে যাওয়ার প্রবণতা বেশি, তাই তাদের জন্য ভাষাসহ অন্যান্য কারিগরি শিক্ষার বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করি। অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুর চাপ কমিয়ে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হলে দেশের জন্য এবং বাংলাদেশের গ্রামের জন্যই ভালো হবে বলে আমার বিশ্বাস।এখন এসব গ্রামের বাচ্চাদের শিক্ষার ভবিষ্যত কেমন হতে পারে?
বর্ণ পরিচিতির পরপরই একজন গ্রামের শিক্ষার্থী তাদের জন্য প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের সাথে পরিচিত হবে। ছোট শ্রেণী থেকেই ঐচ্ছিক, অনৈচ্ছিক বিষয়সমূহ শিক্ষার্থীর চাহিদা এবং শিক্ষকের পর্যালোচনা অনুসারে নির্ধারিত করা যেতে পারে। পরবর্তীতে নবম, দশম শ্রেণীতে কৃষি বিজ্ঞান (কৃষি সম্পর্কিত রসায়ন, জীব বিজ্ঞান), কৃষি অর্থনীতি (কৃষি বানিজ্য, বিপনন), কৃষি প্রকৌশল ইত্যাদি বিভাগ প্রণয়ন করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তা বহাল রাখা হোক।
পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য এদেশে কৃষিতে ডিপ্লোমা আছে, বিশ্ববিদ্যালয় আছে বেশ কয়টি। যেহেতু বৈষম্য না থাকায় কোন কোটা রাখা যাবে না, তাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় ৫০% প্রশ্ন হতে হবে গ্রামীণ শিক্ষার উপর নির্ভর করে।
এসব ছাত্ররা আর সবার মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণ বিভাগগুলোতে অংশ নিতে পারবে। এক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাতে ৫-১০% প্রশ্ন গ্রামীণ শিক্ষানীতির পাঠ্যপুস্তক থেকে রাখার সুপারিশ থাকবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতিমধ্যেই ৩১ দফার ২৪নং দফায় ঘোষণা দিয়েছেন ভবিষ্যতে শিক্ষাখাতে জিডিপির ৫% বরাদ্দ দেবার।
গ্রামীণ শিক্ষানীতি যথাযথ প্রণয়ন হলে সেটা শুধু সর্বোত্তম উপায়ে এসডিজি পূরণেই সাহায্য করবে না, বরং উনার কৃষি অর্থনীতি বিষয়ক ২৭নং দফাটিও অর্জনে সহায়ক হবে। এটার প্রভাবও সামগ্রিক এসডিজিতে পড়বে। তাই প্রাণপ্রিয় নেতা তারেক রহমানের কাছে অনুরোধ থাকবে উনি গ্রামীণ শিক্ষা নীতি প্রণয়নের সামাজিক আন্দোলনে শরীক হবেন এবং এর যথাযথ রূপরেখা প্রণয়নের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার উন্নয়ন নিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা বাস্তবায়নের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবেন।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ,
বিনীত
মুশফিকুর রহমান,সদস্য ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি,যুগ্ম আহবায়ক গফরগাঁও উপজেলা বিএনপি।
আপনার মতামত লিখুন :